কোথাও কেউ নেই

তখনকার বিটিভি এবং এফডিসি ছিল কেলেঙ্কারি বিহীন কিছু নক্ষত্রের একটা উজ্জ্বল গ্যালাক্সি। 

(প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রযোজক বরকতউল্লাহকে ফোন করে অনুরোধ করলেন- হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, নাটকের শেষে বাকেরকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা।
বরকতউল্লাহ ফোন দিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। হুমায়ূন আহমেদ রাজি হলেন না। তিনি স্বাধীনচেতা লেখক। তিনি বিশ্বাস করেন লেখকের স্বাধীনতায়, পরিচালকের স্বাধীনতায়। তিনি স্ক্রিপ্টে যা ভেবে রেখেছেন সেটাই করবেন। জনগনের আন্দোলন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধকে গ্রাহ্য করা লোক তিনি না।

হুমায়ূন আহমেদ তখন আত্মগোপনে আছেন। শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট তিনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তার বাসা। সেই বাসার সামনে রোজ কয়েকশো লোকজন এসে জড়ো হয়, স্লোগান দেয়, সেইসব স্লোগানের মূল ভাবার্থ হচ্ছে, বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেয়া যাবে না। শাহবাগে আরেকদল লোক জড়ো হয়, তাদের ভাষা আরও উগ্র। তারা সেখানে অভিনেতা আবদুল কাদেরের কুশপুত্তলিকা দাহ করে, প্ল্যাকার্ড-ব্যানার নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। আজ, এই ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতেও অবাক লাগবে যে, এতসব কাণ্ডকীর্তি লোকজন ঘটিয়েছিল শুধুমাত্র বিটিভিতে প্রচারিত নাটকের একটা চরিত্রকে ভালোবেসে!

'কোথাও কেউ নেই' নাটকটার সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে। শুরু থেকেই দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে এসেছিল সেটি। চিত্রনাট্য আর পরিচালনা, দুটোই ছিল হুমায়ূন আহমেদের। নাটক যতো এগিয়ে যেতে থাকলো, দর্শকেরা ততই পছন্দ করে ফেললো কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাইকে। আসাদুজ্জামান নূর অভিনীত এই চরিত্রটা সম্ভবত বাংলাদেশের টিভি ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। বাংলা সিনেমাতেও কি বাকের ভাইকে টেক্কা দেয়ার মতো শক্তিশালী কোন চরিত্র তৈরি হয়েছে? আমার অন্তত জানা নেই।

বাকের ভাইয়ের মুখের সংলাপগুলো তখন ঘুরতো তরুণদের মুখে মুখে। তার মতো গলায় চেন ঝুলিয়ে, শার্টের বোতাম খোলা রেখে ঘোরার একটা স্টাইল তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার দোকানে দোকানে বাজতো বাকের ভাইয়ের প্রিয় গান- ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে…’ এই চরিত্রটা এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে, আসাদুজ্জামান নূর যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে নীলফামারী-২ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন, তখন তার কর্মীরা বাকের ভাইয়ের নামে ভোট চেয়েছে, নূরের নামে নয়!

'কোথাও কেউ নেই' নিয়ে কথা হবে, আর সুবর্ণা মোস্তফা একটা বড়সড় জায়গা সেখানে দখল করবেন না, এটা হতেই পারে না। বাংলা নাটকে আর কোন নারী চরিত্র নিজের অভিনয় দিয়ে এতটা প্রভাব তৈরি করতে পারেননি, মুনা চরিত্রে সুবর্ণা যেটা করেছিলেন। নাটকের প্রতিটা সংলাপ, প্রতিটা অভিব্যক্তিতে ব্যক্তিত্ব ঝরে পড়তো তার।

আরেকজনের কথা না বললেই নয়- হুমায়ূন ফরিদী। এই নাটকের সবচেয়ে শক্তিশালী সংলাপগুলো সম্ভবত তার মুখ থেকেই বেরিয়েছে। সাদা আর কালোর মাঝামাঝি অদ্ভুত এক ধূসর রঙে রাঙা চরিত্র তার, শেষদিকে আদালতে বাকেরকে বাঁচানোর জন্যে তার আপ্রাণ চেষ্টাটা মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল দারুণভাবে।

নাটকের শেষদিকে যখন মিথ্যে মামলায় বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিলো, তখনই সবচেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনাটা ঘটলো। প্রিয় চরিত্রের ফাঁসি হয়ে যাবে, এটা মেনে নিতে না পেরে রাস্তায় নেমে এলো সাধারণ মানুষ। হুমায়ূন আহমেদের শহীদুল্লাহ হলের বাড়িতে পাঠানো হলো উড়ো চিঠি, প্রেসক্লাবের সামনে হলো মানববন্ধন। ঢাকার বাইরেও মিছিল বের হলো, স্লোগান উঠলো- ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালী জবাব চাই’, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে…’

সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে কোথাও কেউ নেই এর শেষ পর্ব প্রচারিত হবার কথা, ঢাকা শহরে এর আগেই অবশ্য গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। আগের পর্বে বদি (আবদুল কাদের) কুত্তাওয়ালীর হুমকিতে বাকেরের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে রাজী হয়ে গেছে। ১৪ তারিখে শেষ পর্ব প্রচারিত হলো না, কারণ সেই পর্বের শুটিংই শেষ হয়নি! পরে হুমায়ূন আহমেদ অজানা এক লোকেশনে শেষ করলেন শুটিং, একদম গোপনে।

পরের সপ্তাহে, সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে শেষ পর্বটা প্রচারিত হলো। সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার অবস্থা থমথমে, জেলা শহর আর মফস্বলের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ, ভূতুড়ে রূপ নিয়েছে সেগুলো, যেন কারফিউ চলছে! হুমায়ূন আহমেদ নিজের বাসা ছেড়ে আত্মগোপনে গিয়েছেন আবদুল কাদেরকে নিয়ে, কাদেরের বাসায় হামলা হয়েছে এর আগে, প্রাণভয়ে তিনি থানায় জিডি করেছেন। নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলো।

এরপরের গল্পটা তারা জানেন, নব্বই দশকের সেই গুমোট রাতে যারা বিটিভির পর্দায় 'কোথাও কেউ নেই' নাটকের শেষ পর্বটা দেখেছিলেন, যারা সাক্ষী হয়েছিলেন মুনার কান্নার, অসীম শূন্যতার এক বোবা অনুভূতি তাদের ঘিরে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। ভোররাতে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মুনা কাঁদিয়েছেন হাজারো দর্শককে। আপনি আসামীর কি হন?- জেলারের এই প্রশ্নের প্রশ্নের জবাবে মুনা যখন বলছেন, ‘আমি ওর কেউ না’- তখন চোখের জল আটকে রাখতে পেরেছেন হাতেগোনা কয়েকজন দর্শকই।

সাতাশ বছর আগে 'কোথাও কেউ নেই' এর শেষ পর্বটা প্রচারিত হয়েছিল, এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও যে নাটকের আবেদন আমাদের কাছে ফুরোয়নি। এখনও কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে এই নাটকটা জায়গা দখল করে থাকে, ইউটিউবের প্লে-লিস্টে এখনও 'কোথাও কেউ নেই' বিচরণ করে সদর্পে, ফেসবুকের নিউজফিডেও ঘোরে নাটকের চুম্বক অংশগুলো। সাতাশ বছর পরে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে এই নাটকের অদ্ভুত আবেদনগুলোর গল্প যখন শুনি, পুরো ব্যাপারটাকেই তখন রূপকথা বলে মনে হয়!) 

Comments

Popular posts from this blog

Facts about being actuary !

জমির খতিয়ান কি কত প্রকার ও কি কি?

How to Run C and C++ Program in Sublime Text